‘ওসি প্রদীপের শঙ্কা, ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে তাকে’
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি কক্সবাজারের টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ। ওই হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই আলোচনায় ছিলেন একের পর এক ক্রসফায়ার আর কঠোরতার জন্য। সে সময় মাদক নির্মূলের নামে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে।
টেকনাফে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা।বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে কারাগারের নির্জনে সময় পার করছেন ওসি প্রদীপ। তবে তাকে দেখতে আসছেন না কোনো আত্মীয়স্বজন।ওসি প্রদীপ এখন কোন কারাগারে? কীভাবে সময় কাটান? আগের অপকর্ম মনে করে তার মধ্যে কোনো অনুতাপ আছে কি না? রায় কার্যকর হতে কেন দেরি হচ্ছে?
তার স্ত্রী চুমকি এখন কোথায়? এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ।মৃত্যুদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে কারাগারে দিন পার করছেন ওসি প্রদীপ এবং পরিদর্শক লিয়াকত আলী। রাত-দিন অনেকটা শুয়ে-বসেই দিন কাটছে তাদের। তবে এত অপকর্মের পরেও অনুতপ্ত নন ওসি প্রদীপ, যদিও ফাঁসিতে ঝুলতে হবেই, এমন শঙ্কাও আছে তার।
তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন না পরিবারের কেউ।জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে ওসি প্রদীপ গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারেই রয়েছেন। একই কারাগারে রয়েছেন পরিদর্শক লিয়াকত আলীও। প্রথমে জেল কোড অনুযায়ী, ওসি প্রদীপ ডিভিশন সুবিধা পেতেন।
তবে রায়ের পর অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় ডিভিশন সুবিধা বাতিল হয়ে যায় প্রদীপের। বর্তমানে সাধারণ কয়েদিদের মধ্যে থাকছেন ওসি প্রদীপ।এদিকে, প্রদীপের দুর্নীতির টাকা রক্ষা করতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন তার স্ত্রী চুমকি। দুর্নীতির মামলায় ২১ বছর দণ্ডিত হয়ে তিনিও কারাগারে।
কারা সূত্র বলছে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে কারাগারে দিন পার করছেন ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী। রাত-দিন অনেকটা শুয়ে-বসেই দিন কাটছে তাদের। তবে এত অপকর্মের পরেও অনুতপ্ত নন প্রদীপ, যদিও ফাঁসিতে ঝুলতে হবেই, এমন শঙ্কাও আছে তার। তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন না পরিবারের কেউ কিংবা কোনো স্বজন।
জানতে চাইলে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন জাগো নিউজকে জানান, ওসি প্রদীপ তাদের কারাগারেই রয়েছেন। ফাঁসির আসামি হওয়ায় বর্তমানে তিনি ডিভিশন সুবিধা পাচ্ছেন না। কারাগারে চুপচাপ আছেন ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী।
খাওয়া-দাওয়া আর শুয়ে-বসে সময় পার করছেন তারা।ওসি প্রদীপের আত্মীয়রা সাক্ষাৎ করতে যান কি না জানতে চাইলে সিনিয়র জেল সুপার বলেন, স্বাভাবিক যে নিয়ম তাতে মাসে একবার সাক্ষাৎ করতে পারবেন কয়েদির আত্মীয়রা। তবে ওসি প্রদীপের কোনো আত্মীয় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের এক কর্মকর্তা জানান, এখনো ওসি প্রদীপ আশা নিয়ে আছেন যে, ফাঁসির চূড়ান্ত রায় পেলে তিনি খালাস পাবেন। তার সঙ্গে যেসব বন্দি আছেন তাদের কাছে মাঝে মধ্যে আক্ষেপ করেন, তার শঙ্কা আদালতের সবশেষ রায়ে তাকে ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে।
যত অপকর্ম ওসি প্রদীপের দুর্নীতি ও নানা অপকর্ম করে স্ত্রী-সন্তানের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ। ক্ষমতার জোরে সৎবোন রত্না বালা প্রজাপতির বাড়ি পর্যন্তও দখল করে নিয়েছিলেন তিনি। প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির নামে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যবসাসহ সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে এই মামলায়ও ফেঁসে যান প্রদীপ দম্পতি।
কেন মেজর সিনহাকে হত্যা? ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ। প্রদীপের পরিকল্পনায় সিনহাকে হত্যা করেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী।সেই ওসি প্রদীপ এখন কোথায়?
দেখা করতে যান না পরিবারের কেউ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে ২০২০ সালের ৭ জুলাই কক্সবাজারের রামু থানাধীন হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টের একটি কটেজে ওঠেন।
সেখানে তিনি আশপাশের চিত্রধারণসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তা ভিডিওচিত্রে ধারণ শুরু করেন।ওসি প্রদীপ এও বলেন, তিনি মেজরের ধার ধারেন না। তিনি বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। এসময় প্রদীপ সিনহাদের ভয়ভীতি দেখান, হুমকি দেন এবং কক্সবাজার ছেড়ে যেতে বলেন।এরপর সিনহা টেকনাফে একই ধরনের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ শুরু করেন।
তখন ওসি প্রদীপের মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানায় নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের তথ্য জানতে পারেন। নির্যাতনের শিকার অনেক ভিকটিম পরিবারের সদস্য সিনহা এবং তার সহযোগীদের কাছে প্রদীপের অত্যাচারের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন। এসব শুনে সিনহা এবং তার সহযোগীরা ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী এবং তাদের পেটুয়া বাহিনীর নাম সংগ্রহের চেষ্টা করেন।এসব কাজের একপর্যায়ে ওসি প্রদীপের সঙ্গে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ, শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের দেখা হয়ে যায়। তখন তাদের সঙ্গে ক্যামেরাসহ ভিডিও ধারণের নানা সরঞ্জাম ছিল।
তারা ওসি প্রদীপের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন প্রদীপ তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং তাদের এসব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।ওসি প্রদীপ এও বলেন, তিনি মেজরের ধার ধারেন না। তিনি বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। এসময় প্রদীপ সিনহাদের ভয়ভীতি দেখান, হুমকি দেন এবং কক্সবাজার ছেড়ে যেতে বলেন।প্রদীপ তাদের হুমকি দিয়ে বলেন, ইন্টারভিউ, ভিডিওচিত্র বানিয়ে ইউটিউবে প্রচার করে তার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এবং কর্তৃপক্ষকে জানালে মেজর সাহেব ও তাদের ধ্বংস করে দেবেন।
এরপর ওসি প্রদীপ তার থানা এলাকায় নিয়োজিত সব সোর্সের সঙ্গে কথা বলেন ও গোপন বৈঠক করেন।অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ওসি প্রদীপের হুমকির বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে সিনহা এবং তার সঙ্গীরা নিলীমা রিসোর্টে অবস্থান করেই প্রামাণ্যচিত্রের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তারা কক্সবাজার না ছাড়ায় ওসি প্রদীপের সন্দেহ হয় যে, সিনহা সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার পরিচয় দিয়ে টেকনাফে তার নানা কুকর্মের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে ভিকটিম পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছেন।
এসব অপকর্মের বিষয়গুলো প্রচার হলে তার চাকরির বিরাট ক্ষতি হবে অনুমান করে বিষয়টি তিনি বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে জানান। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী তাদের সোর্স মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ এবং আসামি মো. নিজাম উদ্দিনের মাধ্যমে সিনহা ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে খবর নেওয়ার চেষ্টা করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ।ওসি প্রদীপের ফাঁসির দাবিতে আদালত প্রাঙ্গণে মানববন্ধন এ ঘটনায় ৫ আগস্ট সিনহার বোন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে পুলিশে যোগ দেন প্রদীপ কুমার দাশ।
চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় কর্মরত থাকার সময় ২০০৪ সালে এক নারীর জমি দখলের ঘটনায় বরখাস্ত হয়েছিলেন তিনি। পরে কক্সবাজারের চকরিয়া থানায় উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে কাজ করেন। এরপর জেলার মহেশখালীতে ও সর্বশেষ টেকনাফের ওসি হিসেবে দায়িত্ব পান।ক্রসফায়ার আর ভয়াবহ নির্যাতন স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রদীপ টেকনাফের ওসি থাকাকালীন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১৪৫ জন মানুষ।
সিনহা হত্যার ঘটনার পর ২০২০ সালের আগস্টে কারাগারে যাওয়ার পর ওই বছরের ১২ আগস্ট থেকে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে ১২টি মামলায় ১৫টি হত্যার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ক্রসফায়ার নিয়ে সংবাদ করায় এক সাংবাদিককে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগেও মামলা হয় প্রদীপের নামে। টেকনাফে কীভাবে এত প্রভাব খাটাতেন ওসি প্রদীপ কক্সবাজারসহ সারাদেশে ইয়াবাসহ মাদক ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে মাদকের বিষয়ে তৎকালীন সরকারের নীতি ছিল জিরো টলারেন্স।
তখন ইয়াবার অন্যতম রুট টেকনাফে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন পুলিশ অফিসার খোঁজা হয়েছিল এবং প্রদীপ কুমার দাশকেই সে দায়িত্ব দিয়েছিল সাবেক শেখ হাসিনার সরকার।পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মা ও বোন গত ৩০ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের শাস্তি কার্যকর করার দাবি জানান। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দ্রুত বিচার নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন।স্থানীয় একজন রাজনীতিক বলেন, এ আস্থাই আসলে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সরকারের নির্ভরতার সুযোগে ওসি প্রদীপ এমন কোনো অন্যায় নেই যা করেননি। তার সমালোচনা করায় আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীকে খুন করিয়েছেন মাদক ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে। কারও সাহসই ছিল না তার বিরুদ্ধে কিছু বলার।দ্রুত বিচার নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সহযোগিতার অঙ্গীকার সেনাপ্রধানের গত ৩০ সেপ্টেম্বর সেনাসদরে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সিনহার মা ও বোন।
এ সময় তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং দ্রুততার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের শাস্তি কার্যকর করার দাবি জানান।সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার করেন।
উৎসঃ jagonews24