চোখে চোখ রেখে কথা হবে ভারতের সঙ্গে-আসিফ মাহমুদ
আগামীর বাংলাদেশ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে চলবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বেশি কিছু চায় না। মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের মতপ্রকাশ করতে চায়। তাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে সুখে–শান্তিতে বসবাস করতে চায়।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠের মুক্তমঞ্চে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় আসিফ মাহমুদ এ কথাগুলো বলেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কথা বলতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে এ দেশের মানুষের কথা হবে চোখে চোখ রেখে। কথা হবে মাথা উঁচু করে। বাংলাদেশের মানুষকে কথা বলতে হবে সম্মান দিয়ে। ভারত এত দিন একটি দলের সঙ্গে কথা বলেছে; কিন্তু এখন আর তা হবে না। ভারতকে এখন কথা বলতে হবে এদেশের জনগণের সঙ্গে। বাংলাদেশকে পেছনে ফেলার যে প্র্যাকটিস (চর্চা) তারা এত দিন ধরে করে এসেছে, সেখান থেকে সরে আসতে হবে।
‘দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ সভার আয়োজন করে। একই কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল নারায়ণগঞ্জ, রাঙামাটি, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, মেহেরপুর, পটুয়াখালী, পাবনা ও কুড়িগ্রামে মতবিনিময় করেছেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়কেরা। এই ৯ জেলায় তাঁরা আন্দোলনে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্র-জনতার সঙ্গে সভা করেন। গত রোববার থেকে জেলায় জেলায় গিয়ে এই কর্মসূচি করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
একই সভায় আরেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘জনগণের মতামতের ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। আমরা আপনাদের মতামত শুনতে এসেছি। আমরা সামনের বাংলাদেশের রূপরেখা সেভাবে দেব, যেভাবে দেশের মানুষ মতামত দেবে।’
মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল কাদের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক নিয়ন মনির, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক জিয়াউদ্দিন আয়ান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমন্বয়ক মাহি খান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক রুবেল হোসাইন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে কুমিল্লায় আসা প্রতিনিধি মাহির তাজওয়ার। কুমিল্লার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বক্তব্য দেন কাজী মহিবুর রহমান ও ইয়াসিন আরাফাত।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সভা শুরুর আগে কুমিল্লা টাউন হল মাঠের পশ্চিম দিকে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় মানুষ আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। মাঠের পশ্চিম দিকের বাইরে থেকে দুর্বৃত্তরা তিনটি ককটেল নিক্ষেপ করে বলে জানান কান্দিরপাড় ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) দীনেশ চন্দ্র দাশগুপ্ত।
এ ছাড়া সভার শুরুতে শিক্ষার্থীদের দুটি পক্ষের মধ্যে হট্টগোল দেখা দেয়। পরে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার মাইকে বারবার অনুরোধ জানিয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত করেন।
নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জ শহরের ইসদাইরে অবস্থিত ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামে সভার শুরুতে আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। সমন্বয়ক শ্যামলী সুলতানার সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম, আসিফ আদনান, আবদুল্লাহ্ সালেহীন, সামিয়া মাসুদ, শাহীন মিয়া, মেহরান সিফাত, আবদুর রহমান গাফফারী, মোবাশ্বের; নারায়ণগঞ্জের সমন্বয়ক ফারহানা মানিক প্রমুখ।
সারজিস আলম বলেন, ‘আপনারা কারও লাঠিয়াল বাহিনী হবেন না। আপনি মেধায়, যোগ্যতায়, শিক্ষায় এমনভাবে নিজেকে গড়ে তুলুন; যিনি নিজের ওপর স্বাবলম্বী হবেন, কোনো ভাইয়ের ওপর নয়।’
এর আগে সকালে শহরের ইসদাইরে একটি কমিউনিটি সেন্টারে নারায়ণগঞ্জের সমন্বয়ক ও ছাত্রদের সঙ্গে সভা করেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা। পরবর্তী সময়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতারা মতবিনিময় করেন। আন্দোলনে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের চিকিৎসার খোঁজখবর ও সহায়তার আশ্বাস দেন।
রাঙামাটি: রাঙামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল বিকেলে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, আগামী দিনে এমন একটি দেশ হবে, যেখানে পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের এবং মানুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য-বিভেদ চলবে না। সেখানে সবার জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে।
হাসনাত আবদুল্লাহ সভায় আরও বলেন, পাহাড়ে বিদ্যালয়গুলোতে এখনো শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে যান না। বর্গা শিক্ষক দিয়ে বিদ্যালয় চলে। সেই ব্যবস্থা আর চলবে না। পাহাড়ের মানুষ যাতে সমতলের মানুষের মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারেন, সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
সভায় চট্টগ্রামের ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি, রাঙামাটির সমন্বয়ক আবদুল আহাদসহ অনেকে বক্তব্য দেন।
সিলেট: ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নির্মূল করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নিয়েছেন সিলেটের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এ শপথ নেন শিক্ষার্থীরা। সভায় শিক্ষার্থীদের শপথ পাঠ করান কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম। গোলাম মর্তুজা ও নুরুল ইসলামের যৌথ সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ গালিব, সহসমন্বয়ক ফয়সল আহমদ, আশরাফুল আলম, জুবায়ের আহমদ, আবু সাঈদ, তারেক আহমদ, আসিফ হোসেন প্রমুখ।
মতবিনিময় সভা শুরুর আগে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় ছাত্র সমন্বয়কেরা। পরে দেশাত্মবোধক, বিপ্লবী গান ও কবিতা আবৃত্তি করা হয়।
এর আগে সকালে আন্দোলনে গুলিতে নিহত সাংবাদিক এ টি এম আবু তুরাবের মা মমতাজ বেগমসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন ছাত্র সমন্বয়কেরা। তাঁরা তুরাবের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার আশ্বাস দেন।
পাবনা: পাবনায় ছাত্র-জনতার মতবিনিময় সভায় কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ইফতেখার আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের শুধু টিকটক করলে চলবে না, পড়াশোনা করতে হবে। দেশ ও রাজনীতি সম্পর্কে জানতে হবে। সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের স্বাধীনতা চত্বরে গতকাল বিকেলে আয়ো
জিত এই সভায় ১২ সদস্যের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক দল অংশ নেয়। বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মো. মাহিন সরকার ও আবু ওবায়দা, সহসমন্বয়ক ঐশিক মন্ডল, কুরবাতুল আইন কানিজ, সাইফুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, ফয়সাল আহম্মেদ, আল রকিব, সাদিকুল ইসলাম ও ইমাম হুসাইন।
এর আগে সকালে সমন্বয়কেরা জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও জেলায় দায়িত্বরত সেনাবাহিনী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর ছাত্র আন্দোলনে পাবনায় নিহত দুই ছাত্রের কবর জিয়ারত শেষে সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে মতবিনিময় সভায় যোগ দেন।
মেহেরপুর: মেহেরপুরে সমন্বয়কদের দলটি প্রথমে গতকাল সকাল ১০টায় পৌর কমিউনিটি মিলনায়তনে আন্দোলনে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ওয়াহিদ উজ্জামান, সহসমন্বয়ক আকরাম হোসাইন, আশরেফা খাতুন, আবু বকর খান, ফারহানা ফারিনা, মুইনুল ইসলাম, বিশ্বজিৎ দত্ত, তৌহিদ ইসলাম, বাবু খান, জান্নাত প্রমুখ। পরে উপজেলা প্রশাসন হলরুমে জেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সভা করেন তাঁরা। বিকেলে মেহেরপুর পৌর শহরের শহীদ সামসুজ্জোহা পার্কে ছাত্র-নাগরিক মতবিনিময় সভা হয়। এতে মেহেরপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জ শহরের পুরাতন স্টেডিয়ামে গতকাল বিকেলে আয়োজিত সভায় কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আহনাফ সাঈদ খান বলেন, ‘মব জাস্টিস করবেন না, অপরাধ থাকলে প্রশাসনকে জানাবেন। তবু আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। প্রয়োজনে মামলা করবেন। আমরা এখনো নিরাপদ না। দেশ-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র চলছে এখনো। এ থেকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।’
সভায় আরও বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তৌহিদ সিয়াম, লুৎফর রহমান, আরমানুল ইসলাম, স্বর্ণা আক্তার, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী সাকিব খান, কিশোরগঞ্জের সমম্বয়ক অভি চৌধুরী, ইকরাম হোসেন, উজ্জ্বল, মো. সাবাব; জেলার তাড়াইলে আন্দোলনে নিহত তরিকুল ইসলামের ছোট ভাই জুয়েল আহমেদ, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি মুফতি আবদুর রহিম প্রমুখ।
কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে আয়োজিত সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রকিব মাসুদ বলেন, ‘আমরা বিদ্রোহ করি; কিন্তু বিদ্রোহের পরে আর আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি না। নিজেদের মধ্যেই নিজেরাই বিভেদ তৈরি করি। যার কারণে অন্য মানুষ সুযোগগুলো নেয়।
গতকাল বিকেলে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্র নাগরিক মতবিনিময় সভায়’ তিনি এসব কথা বলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১২ সদস্যের সমন্বয়ক প্রতিনিধিদল সভায় অংশ নেয়। প্রতিনিধিরা হলেন আবু সাঈদ নিয়ন, তরিকুল ইসলাম, রকিব মাসুদ, এস আই শাহীন, মুমতাহিনা মাহজাবীন মোহনা, আবদুল মুনঈম, মিশু আলী সুহাস, জহির রায়হান, ফিহাদুর রহমান, সুমন বসুনিয়া, সজীব ইসলাম, আবদুর রফিক প্রমুখ। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কুড়িগ্রাম পৌর অডিটরিয়ামে মতবিনিময় করে প্রতিনিধিদলটি।
পটুয়াখালী: পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অডিটরিয়ামে বিকেলে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘২৪-এর বিপ্লব আমাদের ছাত্র-জনতার। এই রাষ্ট্র আমাদের ছাত্র-জনতার। কাজেই আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, তা-ও ঠিক করে দেবে ছাত্র-জনতাই। কোনো দল, কোনো গোষ্ঠী তারা ঠিক করবে না।’
সভায় অংশ নেন কেন্দ্রীয় আরেক সমন্বয়ক সানজানা অফিফা, এম এ সাইদ, রাইয়ান ফেরদৌস, সিনথিয়া জাহিন, হাসিবুল হোসাইন, মোবাশ্বেরা করিম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৌহিদ আহমেদ, ঢাকা কলেজের জিহাদ হোসেন, বরিশাল বিএম কলেজের গোলাম রব্বানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাব্বির উদ্দিন প্রমুখ।