জাতীয়

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত

দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। বোর্ডের প্রতিষ্ঠান ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুই দফা দাবিতে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করছেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ২০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা ও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেছেন আন্দোলনরতরা।

পরে সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস পেয়ে রাতে আগামী রোববার পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করেছেন আন্দোলনকারীরা।এদিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন কোটি গ্রাহক। কোথাও কোথাও পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। কোথাও আবার হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে।

এভাবে হুট করে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে জাতীয় গ্রিডও।বাংলাদেশে আরইবিসহ ছয়টি বিতরণ সংস্থা বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এর মধ্যে আরইবিই দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুই দফা দাবি হলো পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে একীভূত করে অভিন্ন সার্ভিস কোড বাস্তবায়ন এবং চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিতদের চাকরি নিয়মিত করতে হবে।

গতকাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্দোলনরত ২০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাঁদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরইবি চেয়ারম্যানের অপসারণ, চাকরি অবসায়নের আদেশ বাতিল ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে। পাশাপাশি দুই দফা দাবি বাস্তবায়ন না হলে কমপ্লিট শাটডাউন করে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।

তবে রাতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হাকিম টেলিফোনে আজকের পত্রিকাকে বলেন, আটক করা কর্মকর্তাদের সকালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস পাওয়ার পর আন্দোলন রোববার পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুতি আদেশ ও মামলা প্রত্যাহার এবং আটকদের মুক্তির দাবি মানা না হলে নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে। এদিকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) প্রকৌশলীরা বলছেন, না জানিয়ে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রগুলো যদি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাতে জাতীয় সঞ্চালন লাইন বা ন্যাশনাল গ্রিড ঝুঁকিতে পড়ে।

যেকোনো সময় গ্রিড ট্রিপ করতে পারে। গ্রিড ট্রিপ করলে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, ‘তাঁদের আলোচনায় আসতে বলেছি। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারও প্ররোচনায় যেন এমন কোনো কাজ না করেন, যাতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। আশা করি, তাঁরা আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

আগামী সপ্তাহের শুরুতেই আলোচনায় বসব।’ তিনি বলেন, ‘তাঁদের অধিকাংশ ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও সমিতির অন্তর্দ্বন্দ্ব দ্রুতই ন্যায্যতার ভিত্তিতে মীমাংসা করার চেষ্টা করা হবে।’পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ না করতে অনুরোধ করা হয়েছে জানিয়ে মাহফুজ আলম বলেন, ‘তাঁদের বলেছি, জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করবেন না। আপনাদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার চেষ্টা করব।’

দেশজুড়ে লাখো গ্রাহকের ভোগান্তি
আরইবি সূত্র বলেছে, সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাটডাউন কর্মসূচি পালনের কারণে গতকাল দেশের অন্তত ৩৫টি জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন এলাকাগুলো কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল। সংশ্লিষ্ট এলাকায় আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যমতে, বিদ্যুৎ বন্ধে ভোগান্তির শিকার হন সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, রংপুর, মাগুরা, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী,

সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, বরিশাল, ঝালকাঠি, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার কেরানীগঞ্জের পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকেরা। মানিকগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের চার কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে সেনাবাহিনী। ফেনীতে পুলিশ পল্লী বিদ্যুতের এক কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে।

মাগুরায় সকাল থেকে বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল ৪ ঘণ্টা। মাগুরা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পারনান্দুয়ালী কার্যালয়ের গ্রাহক মকবুল হোসেন বলেন, ‘কোনো কথা নাই, বার্তা নাই, বিদ্যুৎ নাই সকাল থেকে। বাড়িতে অনুষ্ঠান, গরমে টেকা যাচ্ছে না। এসে শুনি, তারা আন্দোলনের জন্য বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখছে। এটা কোনো কথা হলো? গ্রাহকেরা কী অপরাধ করেছে, যে আমাগের বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিতে হবি?’ কাদির মোল্লা নামের আরেক গ্রাহক বলেন, বিদ্যুৎ বিল নেয় নিয়মিত।

তাহলে আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে কেন গ্রাহকের বিদ্যুৎ বন্ধ করতে হবে? রাজশাহীতে গতকাল বেলা সোয়া ৩টার দিকে কয়েকটি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেত্রকোনার দুর্গাপুরে সকাল থেকে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। পল্লী বিদ্যুতের স্থানীয় অফিসের গেটে তালা দিয়ে চলে যান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফেনীর সোনাগাজী বাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রুবেল বলেন, ‘এমনিতে বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে। এখন বিকেল থেকে নেই। কখন আসবে, তাও জানি না।

দ্রুত বিদ্যুৎ না দিলে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’ এদিকে ফেনীতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ায় এখানকার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক হাওলাদার মো. ফজলুর রহমানকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।জানতে চাইলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সচিব হাসিনা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ চালুর ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। মাঠপর্যায়ের সমিতির অফিসগুলো এ নিয়ে কাজ করছে।’

Show More

Related Articles

Back to top button