দেশজুড়ে

‘এভাবে চলতে থাকলে মানুষের চুরি-ছিনতাই করা ছাড়া উপায় থাকব না’

বিদ্যুতের একটি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতেন মো. বাদশা (৩০)। দুই বছরের মাথায় চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে বেকার হয়ে পড়েন তিনি। পরিবার-সংসার চালাতে একটি চাকরির খোঁজে ঘোরেন শহরের অলিগলি, যান মানুষের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু কোথাও চাকরি নেই। কেউ একটা কাজ দিতে পারেনি। এভাবে বছরখানেক চলার পর হতাশ হয়ে পড়েন

তিনি। পরে একজনের পরামর্শে একটি মোটরসাইকেল কিনে শুরু করেন রাইড শেয়ারিংয়ের কাজ।বাদশার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। থাকেন রাজধানীর কামারপাড়া এলাকার একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী আর যমজ সন্তান নিয়ে। সারা দিন রাইড শেয়ারিং করে যা আয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। সে জন্য প্রায় প্রতি মাসেই বাসা ভাড়া বা অন্যান্য খরচের জন্য

ধারদেনা করতে হয়। কিন্তু এর মধ্যেই জ্বালানির দাম হঠাৎ করে লিটারে ৪৬ টাকা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপালে। আগের অভাবের সঙ্গে নতুন এই টাকার যোগফল কীভাবে মেলাবেন, সেটা নিয়েই ভাবছেন তিনি।আরেক মোটরসাইকেলের চালক মো. কামাল। করোনায় চাকরি হারিয়ে জীবিকার তাগিদে রাইড শেয়ারিংয়ের

কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। মা-বাবা, স্ত্রী–সন্তানসহ ছয় সদস্যের পরিবার তাঁর। থাকেন গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায়। রাইড শেয়ারিং করে যে আয় হয়, তা দিয়ে আর সংসার চলছে না। তাই বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে পাঠিয়েছেন পোশাক কারখানার চাকরিতে। দুজনের আয়ে কোনোরকমে চলছিল সংসার। এর মধ্যেই নতুন করে যোগ হলো অতিরিক্ত তেল

খরচের অঙ্ক। এই বর্ধিত খরচে পরিবার-সংসার কীভাবে টিকবে, সেটা নিয়েই ভাবনা তাঁর।বাদশা ও কামালের মতো একই চিন্তা হাজারো মোটরসাইকেলের চালকের। বিশেষ করে যাঁরা রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাঁদের। হঠাৎ করেই লিটারপ্রতি জ্বালানি খরচ ৪৬ টাকা বেড়ে যাওয়ায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন তাঁরা। পরিবার,

সংসার বা অন্যান্য খরচের সঙ্গে নতুন করে এই টাকার ঘাটতি কীভাবে মেটাবেন, সেটাই ভাবছেন তাঁরা। তা ছাড়া বেশি ভাড়ার শঙ্কায় এরই মধ্যে কমেছে যাত্রী।আজ রোববার সকালে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর মোড়ে গিয়ে দেখা হয় বাদশা ও কামালের সঙ্গে। প্রায় শতাধিক মোটরসাইকেলের চালকের সঙ্গে তাঁরাও বসেছিলেন সেখানে। এর মধ্যেই কিছুটা

সময়ের জন্য কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।বাদশা বলছিলেন, ‘বিদ্যুৎ কোম্পানি থেকে চাকরি চলে যাওয়ার পর আর সোজা হইয়ে দাঁড়াইতে পারি নাই। একটার পর একটা বিপদ আসছে। মধ্যে করোনার কারণে কাজ না পাইয়া খাইয়্যা-না খাইয়্যা দিন কাটাইছি। এখন মোটরসাইকেল চালায়ে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছিলাম। কিন্তু এর মধ্যেই তেলের

দাম বাড়ায় বিপদে পইড়্যা গেলাম। এই ট্যাকার ঘাটতি কীভাবে মেটাব, সেটাই বুঝতেছিনা।’ তাঁর ভাষ্য, আগে ১০০ টাকার তেলে যে পথ যাওয়া যেত, এখন ১৫০ টাকার তেলেও তা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বেশি ভাড়া চাইলে যাত্রীরাও উঠতে চান না। এর ফলে তাঁরা বেশ বিপাকে পড়েছেন।পাশ থেকে কথা বলেন মো. কামাল। তিনি বলেন, ‘ধরেন, আগে ৩০০

থেকে ৩৫০ টাকার তেলে ঢাকার ভেতরে সারা দিন মোটরসাইকেল চালাইতে পারতাম। সব খরচ বাদ দিয়াও আমগোর গড়ে এক হাজার টাকা থাকত। কিন্তু এখন সেই জায়গায় তেলই লাগব প্রায় ৭০০ টাকার। এর বাইরে অন্যান্য খরচ তো আছেই। তাইলে আমরা এখন বাঁচুম ক্যামনে। বেশি ভাড়া চাইলে যাত্রীরাও রাগ করে, উঠবার চায় না। আমরা যামু

কই।’সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের দুই পাশে বসে আছেন মোটরসাইকেলের চালকেরা। অন্য দিনের মতো তাঁদের মধ্যে কাজের প্রতি উচ্ছ্বাস বা কর্মোদ্যম নেই সেভাবে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন তেলের চড়া দাম নিয়ে। কেউ কেউ নিজেরাই ঝাড়ছিলেন ক্ষোভ।আরিফুল ইসলাম নামের এক চালক বলেন, ‘এখানে অনেকেই আছেন

দেশের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস। চাকরি না পেয়ে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছেন তাঁরা। কিছু একটা করে খাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই যে হারে তেলের দাম বাড়িয়ে দিল সরকার, তাতে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে। তেলের দাম বাড়ায় আমরা বেশি ভাড়া চাইলে যাত্রীরা কাছেই আসে না। ট্রিপ না পাইলে আয় কম। আর আয় কম হইলে পরিবার নিয়ে চলব কীভাবে? এভাবে চলতে থাকলে তো মানুষের চুরি–ছিনতাই করা ছাড়া উপায় থাকব না।’

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button